হাসপাতালে ছুটি বাতিল ছাড়াও আলাদা উদ্যোগ

বিবা নিউজ ডেস্ক বিবা নিউজ ডেস্ক

সারা বিশ্বের প্রতিচ্ছবি

প্রকাশিত: ৯:৩৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১০, ২০১৯
শেয়ার করুনঃ

ব্যাগ-বেডিংসহ এক শিশুকে নিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ঢুকছিলেন সাভারের আখলাক হোসেন। অটোরিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিতে দিতে তিনি কালের কণ্ঠকে বললেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ে পাঁচ দিন সাভারের একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিল আমার ভাগ্নিটা। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় আজ এখানে নিয়ে এলাম। ঈদের বন্ধ নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম, কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলাম—এবার নাকি ঈদে ডাক্তারদের কোনো বন্ধ নাই।’

একই হাসপাতালে ভর্তি আরেক রোগীর স্বজন সুরাইয়া বেগম বললেন, ‘এইবার তো ঈদের বন্ধের কোনো আলামত দেখতাছি না। সব ডাক্তার-নার্সরাই তো আছে। কোনো অসুবিধা অইবো বইল্যা তো মনে অইতাছে না।’

গতকাল শনিবার দুপুরেও ঢাকা শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অন্য সময়ের মতোই রোগীদের উপস্থিতি দেখা যায়। হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সফি আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, অন্যবার আর এবারের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকছে ঈদের ছুটিতে। সবার ছুটি তো বাতিল করা হয়েছেই। তার ওপরেও বাড়তি সতর্কতার জন্য প্রতিটি ইউনিটের জন্য আলাদা রোস্টার করা হয়েছে। বিশেষ করে ডেঙ্গু সেলের জন্য থাকবে অধিকতর নজরদারি। ফলে রোগীদের কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ঈদের দিনেও জরুরি বিভাগ ও ইনডোরে স্বাভাবিক চিকিৎসা অব্যাহত থাকবে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও দেখা যায়, ডেঙ্গু রোগী ও তাদের স্বজনদের ভিড়। হাসপাতালের পরিচালক অধাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় এবার মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা দিয়ে সবার ছুটি বাতিল করেছে। এ ছাড়া আমরা নিজস্ব উদ্যোগেও বাড়তি রোস্টার করেছি। এমনকি জরুরি কোনো প্রয়োজন হলে তখন দায়িত্ব পালন করার জন্যও আলাদা বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করেছি।’

ডাক্তারদের ওপরেই ভরসা : স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতিবার ঈদের বন্ধের সময় সব হাসপাতালেই চিকিৎসাব্যবস্থা কিছুটা ঢিমেতালে চলে। বেশির ভাগ চিকিৎসক থাকেন ছুটিতে, স্বাভাবিক সময়ের মতো সেবা মিলে না—তেমন পরিস্থিতির আশঙ্কায় এবার অন্য রোগীদের সঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। সেই উদ্বেগের বিষয়টি বিবেচনা করেই এবার ভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে হাসপাতালগুলো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের নির্দেশনার পাশাপাশি একেকটি হাসপাতাল নিজেদের উদ্যোগেও নিয়েছে বাড়তি কিছু ব্যবস্থা। সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কিংবা ঢাকা শিশু হাসপাতালের মতো ঢাকার অন্য হাসপাতালগুলোও এবার ঈদের ছুটি বাতিল করে স্বাভাবিক সময়ের মতোই ডিউটি রোস্টার তৈরি করে তা অনুসরণ করা শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মনিটরিং সেলও গতকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে পরিস্থিতি দেখতে শুরু করেছে।

জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেই এই ক্রাইসিস সময়ে চিকিৎসকদের অধিকতর দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। ঈদের ছুটিতে তারা রোগীদের পাশে থেকে কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ রোগীদের মূল ভরসার জায়গা কিন্তু চিকিৎসকরাই।’

আওয়ামী লীগের উদ্যোগে গঠিত ডেঙ্গু চিকিৎসা সেলের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন গতকাল সেলের অন্যদের নিয়ে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল ও সেন্ট্রাল হাসপাতালসহ আরো কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা কার্যক্রম দেখেন।

বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে সবই ফ্রি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেঙ্গু সেলের আওতায় গতকাল সকাল থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে ৩০ জন। এ নিয়ে ওই হাসপাতালে মোট চিকিৎসাধীন রোগী আছে ১৮০ জন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া জানান, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বহির্বিভাগে দৈনিক গড়ে ৩০০ জন জ্বরের রোগী সেবা নিচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। চলতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের বহির্বিভাগে পাঁচ হাজার ১৪৫ জন ডেঙ্গু রোগী সেবা নিয়েছে। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে শয্যাসংখ্যা ১৫০ থেকে ২০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে।

ডা. কনক কান্তি জানান, ডেঙ্গু সেলের মাধ্যমে ভর্তীকৃত রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ, স্টেশনারিসহ চিকিৎসাসেবা, বেড ভাড়া এমনকি আইসিইউ ও এইচডিইউ সেবাও বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ডেঙ্গু সেলে আসা রোগীদের প্রাথমিকভাবে সিবিসি, এনএস১, আইজিএম, আইজিএম ও আইজিজি বিনা মূল্যে করা হচ্ছে। আর ঈদের ছুটির মাঝেও ডেঙ্গু সেল খোলা থাকবে। ঈদের পর ১৩ ও ১৪ আগস্ট বহির্বিভাগ খোলা থাকবে। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বহির্বিভাগে সকাল ৯টা থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেবেন।

২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে নতুন রোগী ভর্তি ২১২৭ জন : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক, হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. আয়েশা আক্তারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে মোট দুই হাজার ১২৭ জন। ঢাকার ৪০টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৬৫ জন। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৫৩ জন। এরপরই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগী ভর্তি হয়েছে মিটফোর্ড হাসপাতালে ৬৩ জন, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১১৩, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৭৮,  রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৪, কুর্মিটোলা হাসপাতালে ৭২ জন। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এক হাজার ১১১ জন। সরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা ২৯ জনেই রয়েছে।

চার শিশুসহ আরো পাঁচজনের মৃত্যু : বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা, বরিশাল ও নওগাঁয় চার শিশুসহ আরো পাঁচজন মারা গেছে।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানান, গতকাল সকালে বরিশালের শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছে রুশা মণি (৯) নামের এক স্কুলছাত্রী। সে ঝালকাঠির রাজাপুরের জীবনদাশকাঠি গ্রামের রুহুল আমিন হাওলাদারের মেয়ে। ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা করানো হয় তাকে। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর বৃহস্পতিবার পরিবারের সঙ্গে গ্রামের বাড়ি যায় সে। সেখানেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. বাকির হোসেন জানান, গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে আরো ৮৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে।

নওগাঁ সদর হাসপাতালে নওরীন মাসুদ ডানা (৮) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নওগাঁ মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মাসুদ রানার মেয়ে সে।

ঢাকার মহাখালী এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকালে মারা গেছেন ফরিদপুরের বোয়ালমারীর ব্যবসায়ী নির্মল সাহা (৫৪)। একই দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিফাত (১০) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউএনবি নিউজ। সে জামালপুরের খোরশেদের মেয়ে। বার্তা সংস্থাটি আরো জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় মারা গেছে সায়েরা আক্তার (৪) নামের আরেক শিশু। সে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার কাশিয়ারা গ্রামের অ্যাডভোকেট মমিনুল হকের মেয়ে।

এ ছাড়া নীলফামারীর বিভিন্ন হাসপাতালে গতকাল আরো সাতজনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। যশোর জেনারেল হাসপাতালে নতুন করে ভর্তি হয়েছে ১৫ জন। নওগাঁর সাপাহারে সাতজন, বরিশালের উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৫ জন, কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ছয়জন ও ফরিদপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে আরো ৭৬ জন ভর্তি হয়েছে। এদিকে সাতক্ষীরায় গতকাল পর্যন্ত ১২২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।