ধর্ষণ মহামারী বনাম আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। শামসুর রাহমান সাইমুন এম,এ। লোকপ্রশাসন বিভাগ, কু বি।
বিবা নিউজ ডেস্ক বিবা নিউজ ডেস্ক
সারা বিশ্বের প্রতিচ্ছবি

কলেরা, প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু, এইচআইভি এইডস, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক মহামারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও ধর্ষণকে আজ অবধি কোন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা মহামারী হিসেবে চিহ্নিত বা আখ্যায়িত করেছে কি-না তা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের পরিসীমার বাহিরে। মহামারী প্রত্যক্ষভাবে অসংখ্য মানুষের প্রাণ কেড়ে নিলেও ধর্ষণ বিশ্বব্যাপী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার চেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার সাক্ষী ইতিহাস বহন করছে। বলতে পারেন পরিসংখ্যান তো এমন কিছু দেখাচ্ছে না। হ্যাঁ, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত মানুষ মহামারীতে প্রাণ হারিয়েছে তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণ যন্ত্রণা যে সবধরনের মৃত্যু যন্ত্রণাকে হারমানাতে সক্ষম তা শুধু একজন ধর্ষিতাই অনুধাবন করতে পারেন। মৃত্যু যন্ত্রণা ক্ষণিকের কিন্তু ধর্ষন যন্ত্রণা সারাজীবনের। তাই একজন ধর্ষিতার কাছে ‘ধর্ষণের চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়’। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, ধর্ষণই হচ্ছে সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রাণ কেড়ে নেয়া মহামারী।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এ পর্যন্ত পৃথিবী যতগুলো মহামারীর সম্মুখীন হয়েছে সবগুলোই কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত পৃথিবীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা ও তৎপরতায় বিতাড়িত হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণই একমাত্র মহামারী যা পৃথিবীর আদি থেকে আজ পর্যন্ত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে এবং অপ্রতিরোধ্যভাবে পৃথিবীর সর্বত্রই রাজ করে যাচ্ছে।
ধর্ষণ কোন স্থানীয় বা জাতীয় সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা।
দিনে দিনে এ সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ ধারণ করছে। যার সাথে নতুন মাত্রা হিসেবে যুক্ত হয়েছে শিশু ধর্ষণ। গত দুই দশক ধরে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হারে শিশু ধর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা একটি সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।
এই সমস্যা কোন জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় বা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পৃথিবীর অনগ্রসর ও অনুন্নত জাতি সমূহের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যার পরিমাণ বেশি পরিলক্ষিত হলেও উন্নত ও সভ্য জাতি গুলোও এই সমস্যার উর্ধ্বে নয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, পৃথিবীর অন্যতম ধোনি ও সভ্য দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৪ মিনিটে একটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। অর্থাৎ একদিনে সেখানে ৩৬০ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। তাহলে বাংলাদেশের মত অনগ্রসর দেশগুলোতে এ চিত্র কেমন তা বুঝতে কারো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
ধর্ষণ প্রতিরোধে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশেই কিছু প্রচলিত আইন রয়েছে। নিম্ন এগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।
👉আমেরিকা: ধর্ষিতার বয়স ও ধর্ষণের মাত্রার উপর ভিত্তি করে ৩০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড।
👉রাশিয়া: ২০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড।
👉চীন: কোন ফর্মাল ট্রায়াল নেই, মেডিকেল পরীক্ষায় প্রমাণিত হলেই মৃত্যুদন্ড।
👉পোল্যান্ড: হিংস্র বুনো শুয়োরের খাঁচায় ফেলে মৃত্যুদন্ড।
👉মালয়েশিয়া: মৃত্যুদন্ড।
👉নেদারল্যান্ড: ধর্ষণের আলামতের উপর ভিত্তি করে সাজা।
👉আফগানিস্তান: চার দিনের মধ্যে গুলি করে হত্যা।
👉মঙ্গোলিয়া: ধর্ষিতার পরিবার কর্তৃক মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা।
👉দক্ষিণ আফ্রিকা: ২০ বছরের কারাদণ্ড।
👉সৌদি আরব: শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ।
👉অন্যান্য: পাথর ছুড়ে হত্যা, হাত-পা কাটা, ফাঁসি ইত্যাদি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এমন কঠোর আইন বিদ্যমান থাকা সত্বেও বিশ্বব্যাপী ধর্ষণের প্রবণতা না কমে কেন বাড়ছে! কারণ একটাই, তা হচ্ছে আমাদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার তীব্র অভাব। আমাদের বিদ্যার দৌড় যত বেশিই হোক না কেন তা শুধুই পুঁথিগত বিদ্যার গণ্ডীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নৈতিক শিক্ষার ছোঁয়া যেখানে নেই বললেই চলে। তাই শুধু আইন নয়, এই মহামারী প্রতিরোধে নৈতিক শিক্ষার বিস্তার আবশ্যক।
একনজরে বাংলাদেশের ধর্ষণের চিত্র:
পূর্বেই উল্লেখ করেছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ২৪ ঘন্টায় গড়ে ৩৬০ টা ধর্ষণ সংগঠিত হয়। সুতরাং আমাদের চিত্রটা বুঝতে কারো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও ধর্ষণ বিষয়ক আইন রয়েছে তবে সেটা কতোটা কার্যকর তা বলার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়না।বাংলাদেশে আইনের দুর্বলতার কারণে ধর্ষণের মামলায় অনেক অভিযুক্ত পার পেয়ে যাচ্ছে বলে মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ। তারা বলছেন – আইনের মধ্যে এমন কিছু ত্রুটি রয়েছে, যেগুলো ধর্ষিতার বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।
বেসরকারি সংস্থা ‘নারীপক্ষ’ – এর এক গবেষণায় দেখা যায় ঢাকা, ঝিনাইদহ, জামালপুর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ ও নোয়াখালী সহ মোট ছয়টি জেলায় ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত মোট ৪৩৭২ টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। কিন্তু সাজা হয়েছে মাত্র পাঁচ জনের। আশাকরি বুঝতে পারছেন আমাদের আইনের দৌড় কতদূর। তার চেয়েও আশ্চর্যজনক হচ্ছে আমাদের দেশে এখনো ‘ধর্ষণ’ সংজ্ঞায়িত করা হয় ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী যা বৃটিশ সরকার কর্তৃক প্রণীত। এমনকি আমাদের আইনে এখনো বলা আছে যে “কেউ যদি ধর্ষণের অভিযোগ করেন, তাহলে বিচারের সময় তার চরিত্র নিয়ে নানান ধরনের প্রশ্ন করা যাবে” যা একজন ধর্ষিতার ‘দ্বিতীয়বার ধর্ষণের’ শিকার হওয়ার মতো।
আমাদের দেশের শিশু ধর্ষণের চিত্র :
শিশু ধর্ষণ হচ্ছে কুরুচি ও বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন পশুদের কাজ। এর চেয়ে নিকৃষ্ট কাজ পৃথিবীতে আছে কি-না তা আমার জানা নাই। যা আমাদের দেশে অহরহ ঘটে চলছে। গত ৯ এপ্রিল আশুগঞ্জ থানাধীন ৯ বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের শিকার হওয়া রক্তাক্ত শিশুকে বুকে জড়িয়ে মায়ের আর্তনাদের দৃশ্য যে কতোটা হৃদয়বিদারক হতে পারে তার ব্যাখ্যা দেয়ার সামর্থ আমার নাই। আশা করছি তার পরিবার যথাযথ বিচার পাবে।
এবার দেখে নেয়া যাক আমাদের দেশের শিশু ধর্ষণের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান –
২০১৯ সাল:
👉ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে ৩৯৯ টি শিশু।
👉ধর্ষণের ফলে মারা যায় ১৬ টি শিশু।
👉মৃতদের মধ্যে একজন ছেলে শিশু রয়েছে।
২০১৮ সাল:
👉ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৩৫৬ টি শিশু।
👉মারা যায় ২২ টি শিশু।
সূত্র: মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
ত্রুটিপূর্ণ আইন, দুর্বল বিচার ব্যবস্থা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অপসংস্কৃতির চর্চা, ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থা, প্রশাসনিক নির্লিপ্ততা, নৈতিক শিক্ষার অভাব এসব যতদিন সমাজে বিদ্যমান থাকবে ততদিন ধর্ষণের মহোৎসব এদেশে চলতেই থাকবে।
সার্বক্ষণিক আপনার সন্তানের প্রতি দৃষ্টি রাখুন। সর্বাগ্রে সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, সন্তানকে সবসময় পাশে রাখুন।
শামসুর রাহমান সাইমুন এম,এ।
লোকপ্রশাসন বিভাগ, কু বি।